আইনগত সহায়তা
আইনি সহায়তা (Legal Aid)https://l.facebook.com/বলতে বাংলাদেশে আর্থিকভাবে অসচ্ছল, সহায়-সম্বলহীন এবং নানাবিধ আর্থ-সামাজিক কারণে বিচার পেতে অসমর্থ বিচারপ্রার্থী জনগণকে বিনামূল্যে বা সরকারি খরচে আইনি সেবা প্রদানকে বোঝায়। এর মূল উদ্দেশ্য হলো "সবার জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা" এবং "সুবিচার প্রাপ্তির পথ সুগম করা"।
বিস্তারিত কার্যক্রম এবং সেবাসমূহ:
জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা (NLASO) এবং এর অধীনস্থ কমিটি ও কার্যালয়গুলো এই সেবা প্রদান করে থাকে। নিচে এর আরও বিস্তারিত দিক তুলে ধরা হলো:
১. আইনি পরামর্শ (Legal Advice):
- এটি আইনি সহায়তার প্রথম ধাপ। যেকোনো ব্যক্তি তার আইনি সমস্যা নিয়ে জেলা লিগ্যাল এইড অফিস, সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড অফিস বা জাতীয় হেল্পলাইন ১৬৪৩0-এ যোগাযোগ করে বিনামূল্যে আইনি পরামর্শ নিতে পারেন।
- এই পরামর্শে মামলার সম্ভাব্য দিকনির্দেশনা, আপস-মীমাংসার সুযোগ, এবং পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়।
- লিগ্যাল এইড অফিসার প্রাথমিক যাচাই-বাছাই করে আবেদনকারীর বক্তব্য শোনেন এবং দাখিলকৃত কাগজপত্র পরীক্ষা করেন।
২. আদালতে প্রতিনিধিত্ব (Representation in Court):
- যদি মামলা দায়ের বা পরিচালনার প্রয়োজন হয়, তাহলে লিগ্যাল এইড অফিস যোগ্য আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতে বিনামূল্যে প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা করে।
- এটি দেওয়ানী, ফৌজদারী, পারিবারিক, শ্রম আদালত, এমনকি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ পর্যন্ত প্রযোজ্য।
- মামলা দায়ের, পরিচালনা, আপিল, রিভিশন, রিভিউসহ সকল আইনি প্রক্রিয়ায় আইনি সহায়তা প্রদান করা হয়।
- মামলা পরিচালনার জন্য আইনজীবী নিয়োগ এবং আইনজীবীর ফি, মামলার প্রাসঙ্গিক খরচ (যেমন - কোর্ট ফি, আবেদন ফি, টাইপিং খরচ, নোটিশ জারি খরচ) সরকার বহন করে।
৩. বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (Alternative Dispute Resolution - ADR):
- আইনি সহায়তা আইনে ADR-কে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ছোটখাটো বিরোধ বা পারিবারিক কলহ আদালতের বাইরে মধ্যস্থতা বা সালিশের মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করা হয়।
- এতে দ্রুত ও কম খরচে বিরোধ নিষ্পত্তি হয় এবং সামাজিক সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ থাকে।
- লিগ্যাল এইড অফিসার বা নিযুক্ত মধ্যস্থতাকারী এই প্রক্রিয়ায় সহায়তা করেন।
৪. বিচারপ্রার্থীর যোগ্যতা নির্ধারণ: আইনগত সহায়তা পেতে হলে কিছু নির্দিষ্ট যোগ্যতা থাকতে হয়। সাধারণত নিম্নলিখিত ব্যক্তিরা এই সেবার জন্য যোগ্য বিবেচিত হন:
- আর্থিকভাবে অসচ্ছল ব্যক্তি: যার বার্ষিক আয় একটি নির্দিষ্ট সীমার নিচে। এই সীমা সময়ে সময়ে পরিবর্তন হতে পারে।
- সহায়-সম্বলহীন ব্যক্তি: যার নিজস্ব কোনো সম্পত্তি বা আয়ের উৎস নেই।
- নারী: সকল নারী আইনি সহায়তা পাওয়ার যোগ্য, বিশেষ করে নির্যাতিত নারী।
- শিশু: ১৮ বছরের কম বয়সী সকল শিশু।
- প্রতিবন্ধী ব্যক্তি: শারীরিক বা মানসিকভাবে অক্ষম ব্যক্তি।
- আদিবাসী ও দলিত জনগোষ্ঠী: সমাজের পিছিয়ে পড়া ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী।
- যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা: দেশের জন্য অবদান রাখা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা।
- বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা বা অন্য কোনো সরকারি ভাতার অধিকারী ব্যক্তি।
- বেসরকারি বা আত্মকর্মসংস্থানকারী শ্রমিক: যাদের নির্দিষ্ট মাসিক আয় নির্ধারিত সীমার নিচে।
- কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি।
- জেলখানায় আটক কোনো ব্যক্তি: যিনি আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য আইনজীবী নিয়োগ করতে পারেন না।
- মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী দরিদ্র ব্যক্তি।
- অসহায় বা দুর্বিষহ জীবনের অধিকারী ব্যক্তি।
৫. সাংগঠনিক কাঠামো এবং সেবা প্রদানের পদ্ধতি:
- জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা (NLASO): এটি কেন্দ্রীয় সংস্থা, যা নীতি নির্ধারণ, পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং সামগ্রিক কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করে।
- জাতীয় পরিচালনা বোর্ড: আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী এই বোর্ডের চেয়ারম্যান। এখানে সংসদ সদস্য, অ্যাটর্নি জেনারেল, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব, বার কাউন্সিলের প্রতিনিধি, এনজিও প্রতিনিধি সহ সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা সদস্য হিসেবে থাকেন।
- জেলা লিগ্যাল এইড কমিটি (DLAC): প্রতিটি জেলায় জেলা ও দায়রা জজের নেতৃত্বে এই কমিটি কাজ করে। জেলা জজ আদালত ভবনেই লিগ্যাল এইড অফিস থাকে। এখানে লিগ্যাল এইড অফিসার (বিচারক) সরাসরি আবেদন গ্রহণ ও প্রক্রিয়াকরণ করেন।
- সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটি: সুপ্রিম কোর্টে আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগে আইনি সহায়তা প্রদানের জন্য এই কমিটি গঠিত হয়েছে।
- উপজেলা ও ইউনিয়ন লিগ্যাল এইড কমিটি: তৃণমূল পর্যায়ে মানুষের কাছে সেবা পৌঁছে দিতে এবং সচেতনতা বৃদ্ধিতে এই কমিটিগুলো কাজ করে।
- শ্রম আদালত লিগ্যাল এইড সেল: শ্রম সংক্রান্ত মামলার জন্য বিশেষ কমিটি।
- জাতীয় হেল্পলাইন ১৬৪৩0: এটি একটি টোল-ফ্রি নম্বর, যেখানে ফোন করে আইনি পরামর্শ ও তথ্য পাওয়া যায়। এটি ২৪/৭ সেবা দিয়ে থাকে।
৬. সচেতনতা বৃদ্ধি:
আইনগত সহায়তা কার্যক্রম সম্পর্কে জনগণকে জানানোর জন্য NLASO বিভিন্ন প্রচারমূলক কার্যক্রম হাতে নেয়। এর মধ্যে রয়েছে:
- রেডিও, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রে টিভিসি/বিজ্ঞাপন প্রচার।
- সেমিনার, ওয়ার্কশপ, জনসভা ও উঠান বৈঠক আয়োজন।
- লিফলেট, পোস্টার ও ব্রোশার বিতরণ।
- ওয়েবসাইট ও ডিজিটাল মাধ্যমে তথ্য প্রকাশ।
৭. আইনি কাঠামো:
- আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০: এই আইনটিই বাংলাদেশে সরকারি আইনি সহায়তার প্রধান ভিত্তি। এটি আর্থিকভাবে অসচ্ছল বিচারপ্রার্থীদের জন্য আইনি সহায়তার সংস্থান তৈরি করেছে।
- আইনগত সহায়তা প্রদান (আইনী পরামর্শ ও বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি) বিধিমালা, ২০১৫: এই বিধিমালা আইনি পরামর্শ প্রদান এবং বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির প্রক্রিয়াকে আরও সুনির্দিষ্ট করেছে।
গুরুত্ব:
আইনি সহায়তা মূলত আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মানবাধিকার রক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি নিশ্চিত করে যে কেবল বিত্তশালীদেরই নয়, সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষ যেনো ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়। এর মাধ্যমে বিচার ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা বৃদ্ধি পায় এবং সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা হয়।
Comments
Post a Comment